মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার টিলাগাঁও ইউনিয়নে সনাতনী একটি পরিবারকে এক ঘরে করে রাখার অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় এলাকার কয়েকজন সনাতনী সমাজপতির ইন্ধনে ওই সনাতনী পরিবারের এক ব্যক্তিকে জন্মাষ্টমি অনুষ্ঠানে মন্দিরে প্রবেশে বাঁধা ও মারধরের অভিযোগ এনে মন্দিরের সভাপতিসহ ৯জনের বিরুদ্ধে লিগ্যাল নোটিশ প্রদান করা হয়েছে। এ ঘটনায় স্থানীয় এলাকায় সনাতনী সমাজপতিদের মধ্যে আঞ্চলিক সম্প্রীতি ও বিভেদ সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
এ বিষয়ে রানা সেন গত ১০ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজার জজ কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট প্রিতম দত্তের মাধ্যমে গন্ডারগড় গ্রামের সিতাংশু দে, অনিমেষ দত্ত, পার্শ্ববর্তী তাজপুর গ্রামের শ্রীকেন্দু দে, মনোজ দত্ত, মুকুল সেন, দক্ষিণা দে, নিতাই দত্ত, খন্দখার গ্রামের চন্দন ধর ও টিংকু ধরকে লিগ্যাল নোটিশ প্রদান করেন।
সোমবার সরেজমিন ওই এলাকায় গিয়ে সনাতনী লোকদের সাথে আলাপ করলে তারা জানান, টিলাগাঁও ইউনিয়নের গন্ডারগড় গ্রামের জ্ঞানেন্দ্র সেন খোকার ছেলে রানা সেন পাশ^বর্তী কমলগঞ্জ উপজেলায় বসবাস করে ফার্মেসী দোকানে চাকুরী করেন। সেই সুযোগে তার বাড়ির কাজের মিস্ত্রি পারভেজ নামে এক ব্যক্তির সাথে পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে উঠে তার স্ত্রীর। গত ৫ মাস পূর্বে রানার স্ত্রী ৫ বছরের শিশু সন্তানকে নিয়ে পারভেজের সাথে পালিয়ে গিয়ে কয়েকমাস একত্রে বসবাস করেন। কিন্তু পারভেজ আরো দুইটি বিয়ে করেছেন এর আগে। বিয়ের বিষয়টি জেনে পারভেজের স্ত্রীরা রানার স্ত্রীকে মারধর করে। তখন রানার স্ত্রী ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর রানার স্ত্রীর মৃত বাচ্চা হয়। পরবর্তীতে রানার স্ত্রীকে তার পরিবার কোন স্বীকৃতি দেয়নি। কারণ তাকে সনাতনী নিয়ম অনুযায়ী যাতক (অশৌচক) মানতে হবে। কিন্তু রানার স্ত্রী সেই সনাতনী যাতক মানেননি। পরে রানা নতুন বিয়ে করতে চাইলে হিন্দু সমাজপতিরা বাঁধা দেন। একপর্যায়ে রানা বিয়ে করার জন্য স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছে গিয়ে আবেদন করেন। চেয়ারম্যান এ বিষয়ে কোন অনুমতি দেননি। পরবর্তীতে রানা বিয়ে করতে না পেরে তার শাশুড়ীকে বুঝিয়ে স্ত্রীকে সাথে নিয়ে তার বাড়িতে প্রবেশ করেন। খবর পেয়ে রানা সেনের বাড়িতে সনাতনী সমাজপতিদের মধ্যে তপন দত্ত তপু, অভিমূন্য দে, কমলাকান্ত ভৌমিক, বিজন দত্ত, নিধু বন্দ ধর, সজল দে, অপন ভৌমিক, ধরণী সেন, নিপেন্দ্র পাল প্রবেশ করেন। ওই সমাজপতিরা রানা সেনের বাড়িতে প্রবেশ করেন সেটা এলাকার বেশিরভাগ লোক জানেননা। পরে ওইদিনই সমাজপতিরা রানা সেন ও তার স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেড় হয়ে যান।
সনাতনী লোকদের আরো অভিযোগ, রানা সেনের পরিবারকে একঘরে করে রাখার কোন ক্ষমতা তাদের নেই। স্থানীয় বাসিন্দা সত্য সেনের ভাই অজিত সেনের স্ত্রী মারা যাওয়ায় গত ১৫ আগস্ট বৈষ্ণব সেবা অনুষ্ঠান ছিল। সেই অনুষ্ঠানে গ্রামের সকল সনাতনী লোকদের নিমন্ত্রণ ছিল। সেখানে রানা সেনের পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিল। তাহলে কিভাবে তার পরিবারকে এক ঘরে করে রাখা হলো। এদিকে গত ৬ সেপ্টেম্বর শ্রী শ্রী জগন্নাথ জিউর আশ্রমে শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমি অনুষ্ঠানে উপলক্ষে বিশাল র্যালী হয়। পরে ৭ সেপ্টেম্বর এলাকার নিমন্ত্রিত লোকদের উপস্থিতিতে কীর্তন অনুষ্ঠান হয়। সনাতনী নিয়মনীতি মেনে ও পবিত্রতা রক্ষা করে জন্মাষ্টমী ব্রত করেন সবাই। কিন্তু রানা সেনের পিতা জ্ঞানেন্দ্র সেন খোকা ওইদিন রাত আনুমানিক ৯টায় শুধু লুঙ্গি পড়ে খালি গায়ে মন্দিরে প্রবেশের চেষ্টা করেন। তখন স্থানীয় একজন ব্যক্তি তাকে মন্দিরে প্রবেশ করতে বাঁধা প্রদান করেন। তখন রানার পিতা জ্ঞানেন্দ্র সেন কিছুক্ষণ মন্দিরের বাইরে বসেন। তখন তার ভাইয়ের ছেলে পংকজ সেন রানার পিতাকে ধমক দিয়ে বলেন অপ্রকৃতিগ্রস্থ অবস্থায় কেন নিয়ম না মেনে মন্দিরে প্রবেশের চেষ্টা করেছেন। তখন রানার পিতাকে মন্দির থেকে নিয়ে চলে যান পংকজ সেন। তাহলে কিভাবে ওই পরিবারকে একঘরে করার প্রশ্ন উঠে।
জগন্নাথ জিউর আশ্রম মন্দির কমিটির সভাপতি সিতাংশু দে, সদস্য অনিমেষ দত্ত, শ্রীকান্ত দে, চন্দন ধর, মনোজ দে, সুকেন্দু দত্ত, বিপুল সেন, শ্রীকেন্দু, জ্ঞান চন্দ্র ধর, নিপন দত্ত, অরুণ দে, নিতাই দত্ত, দক্ষিণা দে, সৌরভ ধর, পীযুষ ধর, মতিলাল দত্ত, মিন্টু দে, পলাশ দত্ত, সুমন দে, বিপুল দত্ত, সুব্রত দত্ত, অনুপ দত্ত, অনিরুদ্র দে, পিংকু দত্ত, হরিপদ দে, কেশব দত্ত, মুকুল সেন, বিশ^ দত্ত, গোপাল সেন, শাওন দত্ত, অজিত দত্ত, অজিত দাস, অকিল সেন, সুমিত সেনসহ অনেক ব্যক্তি বলেন, স্থানীয় এলাকায় শ্রী শ্রী জগন্নাথ জিউর আশ্রম নামে একটি মন্দির রয়েছে। সেই মন্দিরের সভাপতি হলেন সিতাংশু দে। তপন দত্ত তপুসহ বেশ কয়েকজন সমাজপতিদের নেতৃত্বে মন্দিরের সভাপতিসহ ৯জন লোককে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে লিগ্যাল নোটিশ দেয়া হয়েছে। এমনকি মন্দির নিয়ে বিভিন্ন অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আমরা এই বিষয়ে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। সনাতনী সমাজপতিদের একটি পক্ষ ইর্ষান্বিত হয়ে বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি করে এলাকায় আঞ্চলিক সম্প্রীতি বিনষ্ট ও বিভেদ সৃষ্টি করার পায়তারায় লিপ্ত রয়েছেন। কয়েকজন ব্যক্তি মন্দিরের কমিটিতে পদ-পদবী পেতে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করছেন। যদি এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এলাকায় কোন বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় তাহলে ওই সনাতনী সমাজপতিরা দায়ী থাকবেন।
এ বিষয়ে রানা সেন বলেন, পারিবারিক কলহের জের ধরে আমার স্ত্রী তার খালার বাড়ি গিয়ে ১ মাস ১০ ছিল। পরে আমাদের মনের মিল হলে স্ত্রী আমার বাড়িতে চলে আসে। আমাদের সমাজের একটি পক্ষ আমাদের সাথে আর অপর একটি পক্ষ আমাদের বিরুদ্ধে। এলাকায় সামাজিক যেকোন অনুষ্ঠানে আমাদের নিমন্ত্রণ দেয়া হয়না। জন্মাষ্টমীর অনুষ্ঠানে আমার পিতাকে মারধর করেছে সমাজপতিদের একটি পক্ষ সেটা আমি শুনেছি। বাড়ির কাজের মিস্ত্রি পারভেজের সাথে আপনার স্ত্রীর কিসের সম্পর্ক এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পারভেজের সাথে আমার স্ত্রীর খারাপ কোন সম্পর্ক নেই। তবে পারভেজ আমার বাড়ির কাজ কিছুদিন করেছিল। পরে তাকে আমার বাড়ি থেকে বিদায় দিয়ে দিসি। এলাকায় বৈষ্ণব সেবায় আমার পরিবারকে নিমন্ত্রণ দেয়া হয়েছে কিনা না আমি সেটি জানিনা। তবে এলাকা থেকে ফোনে আমি যা শুনেছি তা বলছি। সমাজপতিদের মধ্যে কিছু লোক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছেন। তাদের ভয়ে আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে এলাকা ছাড়া। এসব অভিযোগ এনে সমাজপতিরা আমার পরিবারকে একঘরে করে রেখেছেন।
অভিযোগের বিষয়ে তপন দত্ত তপু বলেন, পারিবারিক বিভিন্ন বিষয়ে রানা ও তার স্ত্রীর মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। রানার স্ত্রী যে মুসলিম ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে সেটি কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। তাদের স্বামী-স্ত্রীর বিরোধ আমরা এলাকার সমাজপতি ও পূজা উদযাপন পরিষদের ১৫-১৬ জন লোক নিষ্পত্তি করে দিয়েছি। মন্দিরের সভাপতি সিধাংশু দে’র উপস্থিতিতে জন্মাষ্টমী অনুষ্ঠানে রানার পিতাকে লাঞ্চিত করা হয়েছে। তাই তাদের লিগ্যাল নোটিশ দেয়া হয়েছে। রানার পরিবারের বিষয় নিয়ে কিছু সমাজপতি টানা হেচড়া শুরু করে এলাকায় বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি করে তাদের একঘরে করে রেখেছেন।
জগন্নাথ জিউর আশ্রম মন্দির কমিটির সভাপতি সিতাংশু দে জানান, রানা সেনের স্ত্রীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকায় তাকে সামাজিক ধর্মীয় নিয়ম মেনে ঘরে উঠার কথা বলা হয়েছিল। কিন্ত তিনি সনাতনী নিয়ম মানেননি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সহজ-সরল রানা সেনকে ব্যবহার করে তপন দত্ত তপুসহ কয়েকজন সমাজপতি মন্দিরের পদ-পদবী পেতে আমাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ভূল তথ্য দিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। এলাকার লোকদের সহযোগিতায় মন্দিরটি অত্যন্ত সুন্দরভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে।
টিলাগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ আব্দুল মালিক জানান বলেন, যতুটুকু জেনেছি রানা সেনের স্ত্রী এক মুসলিম ছেলের সাথে চলে যায়। পরবর্তীতে আবার সে ফিরে আসতে চাইলে ধর্মীয় শাস্ত্র বা সমাজ নিয়ে চলতে গেলে যে নিয়ম রয়েছে তা মেনে আসতে হবে বলে স্থানীয় সমাজপতিদের নির্দেশনা মানেনি রানার স্ত্রী। উল্টো সমাজপতিদের কয়েকজনের উপস্থিতিতে রানার বাড়িতে তার স্ত্রীকে প্রবেশ করানো হয়। তবে রানার পরিবারকে একঘরে করে রাখার অভিযোগটি সঠিক নয়। আর জন্মাষ্টমী অনুষ্ঠানে রানার পিতাকে লাঞ্চিত করার অভিযোগ এনে যে লিগ্যাল নোটিশ করা হয়েছে সেটিও ঠিক হয়নি। সনাতনী সমাজপতিদের মধ্যে একটি পক্ষ এলাকায় বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরির জন্য এসব কাজ করে যাচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে আমি পুলিশ প্রশাসনের সাথে কথা বলেছি। উভয়পক্ষকে নিয়ে বসে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করবো।
কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ আব্দুছ ছালেক জানান, বিষয়টি সম্পর্কে পুরোপুরি আমার জানা নেই। তবে খোঁজ নিয়ে দেখবো।