ট্রাডিশনাল খ্রিস্টমাস, উত্তর পশ্চিম স্পেনে কাটানোটা এখন একটা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছরের শেষ প্রান্তের ক’টা দিন ছুটি হিসাবে নিলেও পারিবারিক আন্তরিকতায় তা আরো আনন্দমুখর হয়ে উঠে। পাহাড়ীয়া অঞ্চল আবহাওয়া বিশুদ্ধ, যেমন ঘুম আসে, তেমনি ক্ষূধার উদ্রেক মারাত্বক। যেন অন্য গ্রহের মানূষ আমরা, সব মিলে সময়টা চমৎকার, খুব তাড়াতাড়ি কেটে যায়।
কানাডা থেকে রিমান, সিংঙ্গাপূর থেকে রায়হান সময় মতোই বড়দিনের ছুটি কাটাতে ফিরে এসেছে। প্যারিস থেকে আমরা পাঁচ জনই নানা করোনা বিধি মেনে বিমানে প্রথমে মাদ্রিদ এবং পরবর্তীতে গাড়ীতে ৪০০ কি.মি. অতিক্রম করে গন্তব্যে পৌছালাম।
গাড়ী থেকে নেমেই রোমান, রিমান চিৎকার করে উঠলো, আব্বা, এই যে টনি, কুকুরটা যেন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। আমিও আনন্দের সঙ্গেই ব্যাপারটা উপভোগ করলাম। আশ্চর্যের ঘটনা গুলো অনেক সময়ই একা আসেনা, লক্ষ্য করলাম প্রতি বছরের সেই বিড়ালটাও এখন ফুল টাইম এ বাড়ীতেই বসবাস শুরু করেছে। আমার ছেলেদের একমাত্র মামা, যিনি বিড়ালের জন্য বাসযোগ্য, নিরাপত্তা ব্যাবস্থা সম্মত একটা ছোট টং বাড়ী তৈরী করে দিয়েছেন। ওনার ও আদরের বিড়াল সহ মোট চারটা বিড়াল তাদের আস্তানা তৈরী করে নিয়েছে এই বাড়ীতে।
প্রথম রাতেই লক্ষ করলাম, টনি সেই গতবারের মতো মনিবের বাসায় সারাদিন কাটিয়ে ডিনারের পর যে ভাবে বাড়ী ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছিলো, তা আর গেলোনা। এই ক’মাসের ব্যাবধানে এই পরিবর্তনের কি কারন হতে পারে জানিনা। তবে তার প্রেমিকার সঙ্গে যদি সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে থাকে, তবে মনিবের ভালোবাসা আর যত্নশীলতার প্রতি কৃতজ্ঞতার কারনেই বোধহয় টনি তার পূর্ব পরিচয়ে ফিরে এসেছে। আরো দেখলাম টনির জন্য একটা বিশেষ আরাম দায়ক বিছানার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। তিন, তিনটা গায়ে দেয়ার কম্বলও তাকে বরাদ্ধ করা হয়েছে।
একটা ছোট্ট ঘটনা আমাদের ব্যথিত করেছে, খাবারের সময় গুলোতে টনিকে একটা বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়, ডাইনিংয়ের টেবিলের নিচে তার ঘুর ঘুর করার অভ্যাস। আমরাও অনেকটা বিধি নিষেধ অমান্য করে গোপনে বাড়ীর সবার চক্ষুর আড়ালে কিছু টুকরো মাছ, মাংস, এবং অন্যান্য খাবার টনিকে ছুঁড়ে মারলে, সে অনেক তৃপ্তি সহকারে তা খেতো। কিন্তু তা সে কতোটুকু হজম করতে পারবে তা আমরা ভাবিনি। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা, টনি বিভিন্ন রকম খাবার খেয়ে তা হজম করতে না পেরে, বমি করে সমস্ত ঘর ভরিয়ে ফেলেছে। অতএব কঠিন নির্দেশ, টনিকে তার জন্য কেনা বিশেষ ক্রকেট ছাড়া অন্য কোন খাবার দেয়া যাবেনা। ব্যাপারটা আমাদের মনোপুতঃ না হলেও করার কিছু ছিলোনা। তবুও আমি সাহস করে নিয়ম ভেঙ্গে কিছু মাংসের টুকরা টনির জন্য টেবিলের নিচে ছুঁড়ে দিয়ে ছিলাম। নিতান্ত কেউ দেখে ফেল্লেও আমাকে তেমন কিছু বলার সাহস রাখেনা। এটা শুধু আমার জন্য কার্যকরী হলেও ছেলেরা কিন্তু তা করার সাহস পায়নি।
স্বভাবগত ভাবেই আমরা যখন দুপুরের লাঞ্চের পর পাহাড়ের দিকে হাঁটতে বের হতাম, টনি আমাদের পথ প্রদর্শক হিসাবে কখনো সামনে দূরে চলে যেতো আবার বিপরিতে আমাদের অতিক্রম করে অনেক পিছনে চলে যেতো। তার আনন্দের অতিসজ্জার যেন কোন শেষ নাই।
আমাদের পেয়ে এই চতুস্পদ প্রানীটির অসামান্য উপলব্দি আমাদের আর আশ্চর্য করেনা। আমার নিজের এবং তিন সন্তানের মধ্যে টনি তার শক্তিশালী ভালোবাসায় যে জায়গা করে নিয়েছে, তা আজ অনবদ্য। টনি আজ আমাদের সমস্ত আনন্দ বেদনার সঙ্গী। জানিনা তা সে উপলব্দি করতে পারে? কি না।
কাজী এনায়েত উল্লাহ
লেখক, সংগঠক ও উদ্যোক্তা
মহাসচিব, অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন (আয়েবা)