মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় চোরাই মহিষের মাংসসহ ১০জনকে আটক নিয়ে ধুম্রজাল তৈরী হয়েছে। পুলিশ গভীর রাতে অভিযুক্ত ওই ১০জনকে আটক করে কোর্টে প্রেরণ করলে আসামীদের কয়েকজন আত্মীয় লুকিয়ে তথাকথিত সংবাদ সম্মেলন করে আটককৃতদের নির্দোষ বলে তাদের মুক্তি দাবী করেছেন। তাছাড়া জবাইকৃত মহিষটি তাদের নিজেদের বলে দাবী করলেও ব্যাপক অনুসন্ধান করে এর কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি।
মামলার বাদী এস আই মোঃ আব্দুল আলীম জানান, গত ১৩ মার্চ দিবাগত রাত পৌনে তিনটায় তিনি শহরের দক্ষিণ বাজারে অবস্থানকালে জয়চন্ডী ইউনিয়নের মেরিনা চা বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক এসএম খায়রুল আলম ফোন করে তাকে জানান, স্থানীয় লোকজন ও বাগানের কর্মচারীরা ফ্যাক্টরি অফিসের পূর্বপাশে রাস্তার উপর মহিষের মাংসসহ ১০জন চোরকে তিনটি সিএনজি চালিত অটোরিক্সাসহ আটক করে রেখেছে। তিনি তাৎক্ষণিক বিষয়টি কুলাউড়া থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ আব্দুছ ছালেককে অবহিত করে পুলিশের একটি টিমকে সাথে নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে স্থানীয় জয়চন্ডী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রব মাহবুব, ইউপি সদস্য মোঃ মনু মিয়াসহ স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে মহিষের মাংসসহ ১০জনকে তিনটি গাড়ীসহ আটক করে থানায় নিয়ে আসেন। আটককৃতরা হলেন, পূর্ব কর্মধা গ্রামের মৃত আফতাব আলীর ছেলে আসিদ আলী (৫৫), নুনা গ্রামের মৃত তিতু মিয়ার ছেলে সাফাই মিয়া (৩৫), মৃত সোয়াদ উল্ল্যাহ’র ছেলে তছির আলী (৪০), মৃত ধনাই মিয়ার ছেলে কুতুব মিয়া (৬০), মৃত জোয়াদ উল্ল্যাহ’র ছেলে ওয়াহিদ আলী (৪৫), কামারকান্দি গ্রামের মৃত ছিদ্দেক আলীর ছেলে সায়েদ মিয়া (৪৫), বুধপাশা গ্রামের মৃত আব্দুল লতিফের ছেলে আব্দুল মতলিব (৬২), বাবনিয়া গ্রামের নোয়াব আলীর ছেলে রুফুল মিয়া (২৮), মৃত ধনু মিয়ার ছেলে আফতাব আলী (৪৮) ও কর্মধা গ্রামের মৃত আপ্তাব আলীর ছেলে লকুছ মিয়া (৪৫)। পরদিন ১৪ মার্চ কুলাউড়া থানায় ১০ জনকে অভিযুক্ত করে একটি মামলা নং-১১ দায়ের করে আসামীদের কোর্টে প্রেরন করা হলে আদালত তাদেরকে জেল হাজতে প্রেরণ করে।
এদিকে উক্ত ঘটনার এক সপ্তাহ পর ২০ মার্চ ভুক্তভোগী পরিবারের কয়েকজন কুলাউড়ায় তথাকথিত এক সংবাদ সম্মেলন করে জেলে থাকা আসামীদের মুক্তির দাবী জানান, সংবাদ সম্মেলনের বরাত দিয়ে যুগান্তর, মানবজমিন ও যায়যায়দিনে প্রকাশিত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, আসামীদের নিজের পালিত মহিষ জবাই করে ফেরার পথে একটি মহলের প্ররোচনায় মহিষ মালিকসহ ১০ জন হতদরিদ্র পরিবারের লোককে আটক করে জেলহাজতে প্রেরণ করেছে পুলিশ। এসময় ঘটনাস্থল থেকে ২১৬ কেজি মাংস জব্দ করা হলেও মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে ১০৮ কেজি। কর্মধা ইউনিয়নের বাসিন্দা মাসুক মিয়া (মহিষ মালিকের ভাই) অভিযোগ করে বলেন, তাদের পোষা ১০-১২ টি মহিষ প্রতিবছর শুকনো মৌসুমে কর্মধা ইউনিয়নের পাহাড়ে ছেড়ে দেন। পশ্বাদি ক্রয়-বিক্রয় ও স্বত্বের কাগজপত্রও তাদের আছে। স্থানীয় বন বিভাগও অবগত। প্রতি ১০-১৫ দিন পর পর তারা গিয়ে মহিষগুলো দেখে আসেন। আবার বর্ষাকাল আসলে সেগুলো নিজেদের বাড়িতে নিয়ে আসেন। গত ১৩ মার্চ বিকালে আপ্তাব আলী পাহাড়ে গিয়ে দেখতে পান, তাদের পোষা একটি মহিষ পাহাড় থেকে পড়ে পা ভেঙ্গে মাটিতে শুয়ে আছে। এমতাবস্থায় আপ্তাব আলী লোকজন নিয়ে মহিষটিকে জবাই করে রাত ১০ টার দিকে সিএনজি অটোরিক্সা যোগে বাড়ি ফিরছিলেন। এসময় উপজেলার জয়চন্ডী ইউনিয়নের মেরিনা চা-বাগান এলাকায় আসলে কয়েকজন শ্রমিক তাদের গাড়ি আটকে রাখে। তখন জয়চন্ডী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রব মাহাবুব ঘটনাস্থলে যান। এসময় কর্মধা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান কর্তৃক প্রদত্ত সার্টিফিকেটসহ অন্যান্য কাগজপত্র দেখালেও জয়চন্ডী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তা না মেনে মহিষ মালিক আপ্তাব আলীসহ ১০ জনকে পুলিশের নিকট সোপর্দ করেন এবং জবাইকৃত মহিষের মাংস ওজন করে ২১৬ কেজি জব্দ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে তারা আরো উল্লেখ করেন, কর্মধা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুহিবুল ইসলাম আজাদ তাদের নাকি জানিয়েছেন, তিনি খোঁজ নিয়ে জেনেছেন আপ্তাব আলীসহ যাদের আটক করা হয়েছে তারা মহিষের প্রকৃত মালিক। এরা কেউ চোর নয়, চুরির রেকর্ডও নেই। স্থানীয় ওয়ার্ড সদস্য হেলাল আহমদকে ঘটনাস্থলে পাঠিয়েছেন এবং জয়চন্ডী ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলেছেন, কিন্তু তাঁর কথা না রেখে ওই চেয়ারম্যান সবাইকে পুলিশে সোপর্দ করেছেন। এতে নিরীহ মানুষকে হয়রানি করা হয়েছে বলে জানান।
জয়চন্ডী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রব মাহাবুব জানান, স্থানীয় লোকজন আটক করে আমাকে জানালে আমি ঘটনাস্থলে যাই। মাংস কত কেজি হয়েছে বা কি হয়েছে? এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।
কুলাউড়ায় কর্মরত দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার কোন প্রতিনিধি সংবাদ সম্মেলনের বিষয়ে অবগত নয়। মাত্র তিনটি দৈনিকের প্রতিনিধি এ সংবাদ প্রকাশ করলে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে অনুসন্ধানে নামে সাংবাদিকদের একটি বিশেষ টিম। ব্যাপক অনুসন্ধান করে প্রকাশিত সংবাদের কোন সত্যতা বা ভিত্তি পাওয়া যায়নি। এতেই প্রমাণ হয় যে ওই তিন প্রতিবেদক চোর চক্রের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন এবং কর্মধা ইউপি চেয়ারম্যানের বক্তব্য না নিয়ে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছেন।
সচেতন মহলের মতে, মধ্যরাতে পাহাড়ে মহিষের পা ভেঙ্গে মাটিতে শুয়ে আছে ৩/৪ কিলোমিটার দূর থেকে চোর চক্রের সদস্যরা দেখলো কি করে। মহিষের মালিক তার আত্মীয় স্বজন নিয়ে যেখানে মহিষ উদ্ধার করার কথা সেখানে বিভিন্ন ইউনিয়নের ভাড়াটে লোকজন নিয়ে গভীর রাতে মহিষ জবাই করার কারণ কি? অনুসন্ধানে জানা যায়, পাহাড় থেকে অবাধে মহিষ ও হরিণ শিকার করে ভাগবাটোয়ারা করে নেয়ার একটি চক্র দীর্ঘদিন থেকে এসব অপকর্ম করে আসলেও কয়েকজন জনপ্রতিনিধি ও বিশেষ কয়েকজন ব্যক্তিরা তাদের মদদ দিয়ে যাবার ফলে দিন দিন তারা আরো বেপরোয়া হয়ে পড়েছে। এই চক্র গত বছরের ডিসেম্বরে দুটি হরিণ শিকার করে ভাগবাটোয়ারা করে খাওয়ার সত্যতা পাওয়া গেছে। জেলহাজতে থাকা আসামীদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে মহিষ কান্ডের প্রকৃত সত্যতা বের হয়ে আসবে বলে ধারণা স্থানীয়দের।
কর্মধা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুহিবুল ইসলাম আজাদ জানান, কারো গরু-মহিষ পাহাড়ে ছেড়ে দেয়ার তথ্য আমার কাছে নেই, আটককৃত আসামীদের অনেকেই প্রকৃত চোর। তারা নানা অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে। তিনটি পত্রিকায় আমার বরাত দিয়ে যা লেখা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা বানোয়াট ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত, কোন সাংবাদিক আমার সাথে এ ব্যাপারে কোন কথা না বলে চোরের পক্ষ নিয়ে মনগড়া রিপোর্ট কিভাবে করলো তা আমার বোধগম্য নয়। তিনি প্রকাশিত সংবাদের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই এনামুল হক জানান, জবাইকৃত মহিষের মাংসসহ জয়চন্ডী ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে স্থানীয় লোকজন আপ্তাব আলীসহ ১০জনকে আটক করে পুলিশের নিকট সোপর্দ করেন। থানার অফিসার ইনচার্জ ও গণমান্যব্যক্তি বর্গের উপস্থিতিতে থানায় প্রকাশ্যে মাংস মেপে ১০৮ কেজি নিলামে বিক্রি করা হয়। এখন পর্যন্ত কেউ মহিষের মালিকানা দাবি করেনি। আপ্তাব আলীর পক্ষেও কেউ কাগজপত্র নিয়ে আসেনি। তিনি আরও জানান, উপযুক্ত প্রমানাদি নিয়ে এলে এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হবে। আটকের পরদিন পর্যন্ত কর্মধা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এদের ব্যাপারে কোন ধরনের কথাই বলেননি। এমনি পরিস্থিতিতে মামলা রুজু করে আদালতে সোপর্দ করা ছাড়া কোন উপায় ছিলো না।