মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার তেলিবিল উচ্চ বিদ্যালয়ের সেই দুর্নীতিবাজ ও যৌন কেলেঙ্কারীর সাথে জড়িত প্রধান শিক্ষক নোমান আহমদের পদত্যাগ দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেছে সচেতন এলাকাবাসী ও বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ। ১৮ আগস্ট রোববার সকাল দশটা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত বিদ্যালয়ের সামনে চলে এ কর্মসূচি। এসময় শিক্ষার্থীরা প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শ্লোগান দিয়ে সড়কে টায়ার জালিয়ে প্রতিবাদ করেন। পরে বিক্ষুব্দ শিক্ষার্থীরা প্রধান শিক্ষকের রুম তালাবদ্ধ করে দেয়। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে জনরোষ থেকে বাঁচতে প্রধান শিক্ষক নোমান আহমদ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান।
আন্দোলনরত কয়েক শতাধিক শিক্ষার্থী প্রধান শিক্ষক নোমান আহমদের পদত্যাগের দাবিতে বিভিন্ন শ্লোগান দিয়ে তারা বলেন, “দুর্নীতিবাজ প্রধান শিক্ষক নোমান স্যার যতদিন, ক্লাস বর্জন ততদিন, দফা এক দাবি এক নোমান স্যারের পদত্যাগ, নাই শরম নাই লেশ, অবৈধ মাস্টারের দিন শেষ, অবৈধ হেড মাস্টার মানি না মানবো না, এক দুই তিন চার, নোমান মাস্টার গদি ছাড়, বছর শেষের পাশের হার, মান-সম্মান ছারখার”।
শিক্ষার্থী, এলাকাবাসী ও সাবেক শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, প্রধান শিক্ষক নোমান আহমদ একজন দুর্নীতিবাজ, দখলদার, চরিত্রহীন। তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর ২০০৮-২০২৪ পর্যন্ত বিদ্যালয়ের প্রায় ১০০০-১২০০ শিক্ষার্থীদের বেতন খাতের আয় ২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা, ভর্তি ফি, সনদ ফি, টিউটোরিয়াল, পরীক্ষা ফিসহ ১ কোটি ৬০ লাখ টাকাসহ মোট ৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকা আয় হয়। এরমধ্যে ব্যয় হয়েছে ৭৯ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। কিন্তু বাকি টাকা ব্যাংকে জমা থাকার কথা থাকলেও ৩ কোটি ৭৬ লাখ ৩২ হাজার টাকা ব্যাংকে জমা নেই। ওই টাকা প্রধান শিক্ষক নোমান আত্মসাৎ করেছেন। এমনকি বিদ্যালয়ে তাঁর আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে অনেককে অনিয়ম দুর্নীতি করে চাকুরী দিয়েছেন। প্রধান শিক্ষক নোমানের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে বিদ্যালয়ে ম্যানেজিং কমিটি গঠন হয়নি। তাঁর ইচ্ছামাফিক বিদ্যালয় পরিচালনা করে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি করে যাচ্ছেন
স্থানীয় লোকজন জানান, ২০১৯ সালে প্রধান শিক্ষক নোমানের বিরুদ্ধে বিদ্যালয়ের এক সহকারী শিক্ষিকাকে যৌন হয়রানি করার অভিযোগে থানায় মামলা করেন বিদ্যালয়ের ওই শিক্ষিকা। ওইসময় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দপ্তর থেকে যৌন হয়রানির বিষয়ে তদন্ত করলে যৌন হয়রানির বিষয়টি প্রমাণিত হয়। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে ওই শিক্ষিকা স্কুল থেকে চাকুরী ছেড়ে দেন। এদিকে প্রধান শিক্ষক নোমান নিজ ক্ষমতাবলে নিয়ম বহির্ভূতভাবে বিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে ৮-১০ জনকে খন্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দেন।
স্থানীয় লোকজন আরো জানান, প্রধান শিক্ষকের স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়মের কারণে গত ১৬ বছর ধরে এ বিদ্যালয়ে অভিভাবকদের ভোটে নির্বাচিত কোন পরিচালনা কমিটি দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। প্রধান শিক্ষক স্থানীয় কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার সহযোগিতা নিয়ে নিজেকে আওয়ামী লীগ নেতা পরিচয় দিয়ে একের পর এক অনিয়ম ও দূর্নীতি করেছেন। এর আগে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা সচিব, স্থানীয় সংসদ সদস্য, দুদক চেয়ারম্যান, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড সিলেট, জেলা প্রশাসক মৌলভীবাজার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কার্যত কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
অভিযোগ থেকে জানা যায়, ১৯৪৫ সালে তেলিবিল উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্টালগ্ন থেকে বিদ্যালয়টি অনেক সুনামের সাথে পরিচালিত হয়ে আসলেও বিগত প্রায় ১৬ বছর ধরে ক্রমান্বয়ে নানান অব্যবস্থাপনার কারনে প্রধান শিক্ষক এলাকার কিছু স্বার্থান্বেসী মহলের সাথে যোগসাজস করে বিদ্যালয়টিকে অনিয়ম, দূর্নীতি আর লুটপাটের আখড়ায় পরিনত পরিণিত করেছেন। ১৬ বছর ধরে নানান অনিয়মের মাধ্যমে ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। বিদ্যালয়ে কোন নির্বাচিত ম্যানেজিং কমিটি না থাকায় এবং প্রধান শিক্ষক তার নিকট আত্বীয়কে (মামা/চাচা) ম্যানেজিং কমিটির ভূয়া সদস্য বানিয়ে বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর হিসাব-নিকাশ ছাড়াই বিদ্যালয় তহবিলের ৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকাসহ সরকারী অনুদানের টাকা আত্বসাৎ করেছেন। ১০০০-১২০০ ছাত্র-ছাত্রীর জন্য মাত্র ৫ জন এমপিওভূক্ত শিক্ষক যাহা কোনভাবেই পর্যাপ্ত নয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত বেতন/ফি’র অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হয়। বিদ্যালয়ের নামে একটি ব্যাংক একাউন্ট থাকাসত্বেও সেখানে কোনপ্রকার লেনদেন না করা। লক্ষ লক্ষ টাকা উৎকোচের বিনিময়ে অযোগ্য ব্যক্তিদেরকে বিভিন্ন সময়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষক পদে নিয়োগ দান। বিদ্যালয়ের বিভিন্ন পদে নিজের পরিবারের লোকদের (আপন ভাগিনা ও ভাতৃবধু) অবৈধভাবে নিয়োগ দান, সরকারী শিক্ষা উপবৃত্তির টাকা ভূয়া প্রার্থী বানিয়ে এবং জাল স্বাক্ষর করে আত্বসাৎসহ পাহাড়সমান অভিযোগ রয়েছে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
অভিযোগ সম্পর্কে প্রধান শিক্ষক নোমান আহমদের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করলে তিনি ফোন রিসিভ করে কোন কথা না বলে ফোন কেটে দেন। এজন্য তাঁর বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
বিদ্যালয়ের প্রাক্তণ শিক্ষার্থী এড. জসীম উদ্দিন আহমদ, এম আক্তার আলী, সাজিদুর রহমান, সৈয়দ কামাল উদ্দিন, লুৎফুর রহমান বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে অবিলম্বে সরকারের নিরপেক্ষ নিরিক্ষা সংস্থার মাধ্যমে দুর্নীতিবাজ প্রধান শিক্ষক নোমান আহমদের নানাবিধ অনিয়ম ও দূর্নীতির তদন্ত করতে হবে। একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ভোটের মাধ্যমে নতুন ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন করে জবাবদিহীতামূলক প্রশাসন ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করে এলাকাবাসির দীর্ঘ দিনের প্রতিক্ষার অবসান করার জন্য সংশ্লিস্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মহি উদ্দিন বলেন, পরিস্থিতি শান্ত করতে ঘটনাস্থলে ছুঁটে যাই। ঘটনাস্থলে প্রধান শিক্ষক কিংবা ম্যানেজিং কমিটির কাউকে পাইনি। শিক্ষার্থীদের আশ^স্ত করেছি যে, প্রধান শিক্ষক ও কমিটির লোকদের ডেকে এনে আলোচনা করে পরবর্তী প্রদক্ষেপ নেয়া হবে। সার্বিক বিষয়টি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে।